দু’বছরের মধ্যেই নিজের জেলায় অনেকটা পিছিয়ে পড়লেন শুভেন্দু

Staff Reporter

দু’বছরের মধ্যেই নিজের জেলায় অনেকটা পিছিয়ে পড়লেন শুভেন্দু, পূর্ব মেদিনীপুরও তৃণমূলেরই

সারা বাংলার নজর ছিল পূর্ব মেদিনীপুরের দিকে। বিরোধী দলনেতার জেলায়, বিরোধী দলনেতার টিম কি রাজ্যের শাসকদলকে কোণঠাসা করার জন্য পারবে? না কি শুভেন্দুকে ছাড়াই এ বার জেলা অধিকার করবে তৃণমূল?

পূর্ব মেদিনীপুরে ‘ভাল’ ফল করল বিজেপি। অথচ শুভেন্দু অধিকারীর ফল ‘স্বস্তির’ হল না। তাঁর নেতৃত্বেই ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূল বিরোধীশূন্য করে দিয়েছিল পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদকে। শুভেন্দু তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন তার বছর আড়াই পর ২০২০-র ডিসেম্বরে। ২০২১ বর্ষের বিধানসভা ইলেকশনে জেলায় তৃণমূলের হতে ঈষৎ পিছিয়ে থাকলেও প্রায় সমানে সমানে লড়ে গিয়েছিল বিজেপি। এ বারের পঞ্চায়েত ভোটে সারা বাংলার নজর ছিল এই জেলার দিকে। বিরোধী দলনেতার জেলায়, বিরোধী দলনেতার টিম কি তাঁর পুরনো দলকে কোণঠাসা করতে পারবে? না কি শুভেন্দুকে ছাড়াই আবার স্বচ্ছন্দে জেলা কর্তৃত্ব করবে তৃণমূল?

ফলাফলের পর দেখা যাচ্ছে, তৃণমূল কেবল পূর্ব মেদিনীপুর দখলেই রাখল না, জেলা পরিষদের ৭০ আসনের ভিতরে ৫৬টিই তাদের দখলে। বিজেপি আটকে গেল ১৪-তেই। পূর্বের পঞ্চায়েত ভোটের নিরিখে দেখতে গেলে বিজেপির উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন নিঃসন্দেহে। অথচ শুভেন্দুর কাছে এই ফল যে একেবারেই ‘স্বস্তিজনক’ নয়, তা হয়তো-বা তিনি নিজেও জানেন।

Advertisement

জেলা পরিষদ ছাড়াও পূর্ব মেদিনীপুরে পঞ্চায়েত তার সাথে গ্রাম পঞ্চায়েতের লড়াইয়েও বড়সড় দখল বজায় রেখেছে তৃণমূল। জেলায় পঞ্চায়েত সমিতির পরিমান ২৫। এর মধ্যে কাঁথি-১, নন্দীগ্রাম-২ এবং শহিদ মাতঙ্গিনী— এই তিনটিতেই শুধুমাত্র বিজয় পেয়েছে বিজেপি। এর ভিতরে কাঁথি-১ অধিকারী পরিবারের এলাকা কাঁথি শহরেরই লাগোয়া। এগরা-২ পঞ্চায়েত পরিচালক সভা ত্রিশঙ্কু। অবশিষ্ট ২১টিতেই বিজয়কেতন উড়িয়েছে তৃণমূল। গ্রাম পঞ্চায়েতের ক্ষেত্রেও প্রাধান্য বজায় রেখেছে শাসকদল। ২২৩টির ভিতরে ১৭৫টিতেই জয় শিওর করেছে তৃণমূল। বাকিগুলির মধ্যে বিজেপির দখলে যেমন কতিপয় থাকছে, তেমনই কতিপয় পঞ্চায়েত ত্রিশঙ্কু। এই পঞ্চায়েতগুলিতে তৃণমূলের টিকেট না পেয়ে নির্দল হয়ে জয়ীরাও ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে রয়েছেন। জেলা তৃণমূলের অনেক নেতাই নিশ্চিত, এগুলির অর্ধেকের বেশি শেষমেশ ওঁদের দিকে আসবে। এমনকি, বিজেপিও এই ত্রিশঙ্কু পঞ্চায়েত বোর্ড নিয়ে ভীষণ একটা আশাবাদী নয়। তাদের হেতু স্মরণ বরং জেতা পঞ্চায়েত ধরে রাখা।

তবে শুভেন্দুর দলকে ভাল ভাবে আটকেও সুখী নয় তৃণমূল। এমনটাই দাবি জেলার বিধায়ক এবং রাজ্যের কারামন্ত্রী অখিল গিরির। আনন্দবাজার অনলাইনকে অখিল বলেন, ‘‘আমরা ভাল ফল করেছি। অথচ এইরকম ভাল ফল করতেই পারতাম। সম্ভবত কতিপয় ভুলভ্রান্তি হয়েছে বলেই সব আসনে বিজয় আসেনি। তা সত্ত্বেও পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় যে মুখ্যমন্ত্রীর কাজের ফসল হিসেবেই আমরা জয় পেয়েছি, তা মেনে নিতেই হবে।’’ শুভেন্দুর নাম না করে তাঁর সংযোজন, ‘‘কোন দলের কোন নেতা কী ফলাফল আশা করেছিলেন আমরা জানি না। কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় সিপিএম, বিজেপি তার সাথে কংগ্রেস নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে জোট করেছিল। কিন্তু ব্যক্তি দেখিয়ে দিয়েছেন যে, বিধান বিসর্জন দিয়ে ভোটযুদ্ধ জেতা যায় না।’’

তবে বিজেপির ফলাফলে আশাহত নন পূর্ব মেদিনীপুরে টিমের জেলা সহ-সভাপতি প্রলয় পাল। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের ফলাফল ভালো না হয়েছে, এটা আমরা মনে করি না। কারণ, এই পঞ্চায়েত ভোটের আগে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় একটি গ্রাম পঞ্চায়েতও বিজেপির ছিল না। ওই জায়গা আমরা জেলা পরিষদে সম্মানজনক আসন নিয়ে বিরোধীদল থেকে যাচ্ছি। তিনটি পঞ্চায়েত সমিতি-সহ বেশ কতিপয় গ্রাম পঞ্চায়েত জিতেছি। তাই এই ফলাফলকে কোনও ভাবেই মন্দ বলা যাবে না।’’

Advertisement

কিন্তু বিরোধী দলনেতা স্বয়ং দীর্ঘ দিন ধরে কোম্পানি করেছেন যে জেলায়, সেখানে এই ফল কি সত্যিই সন্তোষজনক? বিজেপি নেতার মতে, ‘‘শাসকদলের সন্ত্রাসের কারণেই অধিক জায়গায় লড়াই করেও ফল আশানুরূপ হয়নি। বিরোধী দলনেতার বিধানসভা কেন্দ্রে নন্দীগ্রাম-১ ব্লকের সামসাবাদ, কেন্দেমারি, দাউদপুর পঞ্চায়েতে আমাদের প্রার্থী দেওয়ার জন্য দেওয়া হয়নি। পর্যাপ্ত আসনে অবাধ ছাপ্পা হয়েছে। শুধু নন্দীগ্রামই নয়, পূর্ব মেদিনীপুর জেলা জুড়েই সাধারণ মানুষকে ভোট দেওয়ার জন্য দেওয়া হয়নি। যদি ভোট দিতে দেওয়া হত, তা হলে আমাদের ফল গোটা পূর্ব মেদিনীপুর জেলাতেই আশাতীত হত।’’

শুধু পঞ্চায়েত ভোটের বিচারে দেখলে, ২০১৮ হতে ২০২৩ বিজেপির এক বড় লাফ। সে বার বিজেপি ‘শূন্য’ ছিল সর্বত্রই। অথচ এর মাঝে পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা রাজনীতিতে জ্যেষ্ঠ সংশোধন ঘটে গিয়েছে। যে অধিকারী ফেমেলির নেতৃত্বে তৃণমূল জেলা সংস্থা চলেছে প্রায় দু’দশক, সেই পরিবারের তৃণমূল থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অভিঘাত অনেক কম নয়। শুভেন্দু বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর রাজ্যে প্রথম বড় ভোট হয় ২০২১ সালে। বিধানসভা ভোটে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় বিজেপি কেবল প্রথম জেতে তা-ই নয়, ১৬টি আসনের মধ্যে ৭টি বিজয় লাভ করে নেয় তারা। তৃণমূল পেয়েছিল ৯টি। তার পর ২০২২ বর্ষের পুরভোটে অবশ্য শুভেন্দুর টিম মন্দ ফল করে। জেলার চারটি পুরসভার চারটিই অধিকার করে তৃণমূল। এর ভিতরে বিদ্যমান কাঁথি পুরসভাও। বর্ষের পর বছর যার মাথায় থেকেছেন অধিকারী ফেমেলির সদস্যেরা। পুরসভার পর পঞ্চায়েত ভোটেও বিজেপিকে অনেকটাই পিছনে রাখল তৃণমূল। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েই আগামী বছর থেকে যাচ্ছে লোকসভা ভোটের লড়াই। তৃণমূল নেতাদের দাবি, পঞ্চায়েতের বিধান বজায় থাকবে সেই ভোটেও।

এই পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূল নেতৃত্বকে আলাদা স্বস্তি দিয়েছে নন্দীগ্রাম বিধানসভা এরিয়ায় জেলা পরিষদ আসনের ফলাফল। নন্দীগ্রাম বিধানসভার অধীনে যে ৫টি জেলা পরিষদ আসন রয়েছে, তার রেজাল্টের নিরিখে ১০,৪৫৭ ভোটে এগিয়ে বিদ্যমান তৃণমূল। বিরোধী দলনেতার বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপিকে এই ধকল দেওয়ার জন্য পেরে বেশি তৃপ্ত তৃণমূল শিবির। কারণ, এই নন্দীগ্রামেই মুখ্যমন্ত্রী টান বন্দ্যোপাধ্যায়কে ১,৯৫৬ ভোটে হারিয়ে জিতেছিলেন শুভেন্দু।

Advertisement

আরও পড়ুন

Latest articles

Leave a Comment

%d bloggers like this: