হাপুস আখিতে কাঁদছেন ভোটকর্মী

Staff Reporter

হাপুস আখিতে কাঁদছেন ভোটকর্মী, কেউ পালাচ্ছেন ভয়ে, এমনকি এই ছবিও দেখল ভোটের বাংলা!

হাতে সাইকেলের চেন। তার সঙ্গে লাগানো বিদ্যমান লোহার বল। দোলাতে দোলাতে বুথে ঢুকছে একদল যুবক। এরূপ দৃশ্যের বর্ণনা দিতে দিতে টেলিফোনে ঘাড়সমেত মাথা কাঁপছিল পঞ্চাশোর্ধ সরকারি কর্মীর।

হাউ হাউ করে কেঁদে চলেছেন। ভোটকর্মী হয়ে এসেছিলেন মুর্শিদাবাদের রানিনগরে। বুথের বাইরে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে সইদুল ইসলাম বলছেন, ‘‘জীবন নিয়ে ফিরলাম।’’ কান্নায় গলা আটকে যাচ্ছিল। কী হয়েছিল? জিজ্ঞাসা করতে খানিক দম নিয়ে বললেন, ‘‘বুথ ক্যাপচার, বম্বিং, ইটবৃষ্টির ভিতরে কোথায় যাব? কোথায় পালাব?’’ বাংলার ভোটের বদনাম দেশ জুড়েই। আজ নয় শুধু। সব আমলেই। সেই বাংলাও ভোটকর্মীর এরূপ কান্নার দৃশ্য মনে করতে পারছে না। সিকিউরিটি ছিল না? জানতে চাওয়ায় সইদুল বললেন, ‘‘কোনও নিরাপত্তা নেই। একটা সিভিক, একটা রাজ্য পুলিশ। তারাও পালাচ্ছে, কী নিরাপত্তা দেবে? লুকোনোর জন্য বাথরুম যাওয়া যায় কি না বিবেচনা করে শেষে বেঞ্চের তলায় চুরি করে ছিলাম।’’ এই দৃশ্যস্থল বুথ নম্বর ৬২। রানিনগরের কালিনগর প্রাইমারি বিদ্যালয়।

এমন ঘটনা কেবলমাত্র একটি বুথে নয়। রাজ্যের নানা বুথেই দেখা গিয়েছে শনিবার। হাতে সাইকেলের চেন। তার সাথে লাগানো বিদ্যমান লোহার বল। দোলাতে দোলাতে বুথে ঢুকছে একদল যুবক। এমন দৃশ্যের বর্ণনা দিতে দেওয়ার জন্য টেলিফোনে কাঁপছিল পঞ্চাশোর্ধ রাষ্ট্রীয় কর্মীর। বললেন, ‘‘ভয় করছিল! প্রচুর ডর করছিল। যখন হাতে ভোজালি নিয়ে ওরা প্রাথমিক স্কুলের ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে তেড়ে এল। সেই সময় সত্যিই বলছি, প্রচণ্ড শঙ্কা করছিল।’’ শনিবার পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি মহকুমার ১টি ভোটকেন্দ্রে ‘ডিউটি’তে ছিলেন ওই ভদ্র মহিলা সরকারি কর্মী। নাম বলার কতিপয় ক্ষণ পরই আবার বলে উঠলেন, ‘‘আমার নামটা দেবেন না প্লিজ। আমি শঙ্কা পাচ্ছি।’’ জীবনের শুধুমাত্র সম্বল ছেলে পড়াশুনোর জন্য বেঙ্গালুরুতে। সেই সময়টায় শুধু সেই ছেলের মুখটাই বার বার ভেসে উঠছিল, জানালেন তিনি। কেন্দ্রীয় বাহিনীর কোনও জওয়ানকে সারাদিন দেখতে পাননি। সকালের দিকে দু’জন পুলিশকর্মীকে বুথের বাইরে দেখতে পেলেও, প্রয়োজনের টাইম ওঁদের আর লক্ষ্য যায়নি বলেই অভিযোগ।

Advertisement

ভোর থেকেই ভোটের পরিকল্পনা চালু করেছিলেন ওই ভোটকর্মী ও তাঁর সঙ্গীরা। ধীর গতিতে ভোটাররা ওই ভোটগ্রহণ কেন্দ্র ইলেকশন দিতেও এসেছিলেন। ১ম দিকে সবই ঠিকঠাক চলছিল। বেলা ১০টার কিছু পরেই কাটল তাল। এই ভোটকর্মীর কথায়, ‘‘আচমকাই একদল যুবক এসে ঢুকে পড়লেন। প্রায় সবার হাতে অস্ত্র। কারও হাতে ভোজালি, কারও হাতে লাঠি। সাইকেলের চেন হাতে জড়িয়ে। তাতে লোহার বল লাগানো। কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না।’’

ব্যারাকপুর কাউগাছি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার আদিবাসী প্রাইমারি স্কুলে ভোটগ্রহণের কাজ করতে এসেছিলেন শিক্ষাকর্মী সুজিত দাস। এই ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে আবার আরম্ভ থেকেই আধিপত্য নিয়ে নিয়েছিল একদল সশস্ত্র যুবক। জানালেন সুজিত। ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে ২ জন পুলিশ সহযোগীকে মোতায়েন রাখা হয়েছিল। তবুও বিশেষ কোনও অবদান নোটিশ যায়নি বলেই অভিযোগ সুজিতের।

ওই ভোটকর্মীর কথায়, সকালের দিকে এলাকার প্রয়াত কিংবা প্রবাসীদের ইলেকশন দিয়ে দেওয়া হল। তার পর বেলা ১২টা পর্যন্ত চলেছে ঢালাও ছাপ্পা। সুজিতের অভিযোগ, ‘‘এটা সঠিক যে কেউ আমাদের মারধর করেনি। তবুও যে পরিমাণ গালিগালাজ করা হয়েছে, তা মারধরের থেকে কোনও ভাগে কম নয়। লাঠিসোটা, ছুরি প্রভৃতি নিয়ে আমাদের সম্মুখে দিয়ে বার বার ঘোরাফেরা করে ওরা বোঝাতে চাইছিল, যে টুঁ শব্দটি করবে তাকেই দেখে নেবে। এই অসম্মান চিরকাল মনে থাকবে।’’

Advertisement

ভোটের সারা দিন বিভিন্ন জেলার বেশ কয়েকটি বুথেই ভোটকর্মীদের অসহায় পিকচার ধরা পড়েছে। কোথাও মহিলা ভোটকর্মী মুখে হাত ঢেকে কেঁদে চলেছেন। কেউ বলছেন, ‘‘ভালয় ভালয় আলয় ফিরতে চাই।’’ ভোটকর্মীদের সুরক্ষার জন্য সরকারি সহযোগীদের দুইটি সংগঠনের তরফে হেল্পলাইন ও হেল্পডেস্কের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। দুইটা সংগঠনেরই অভিযোগ, শাসকদল তৃণমূল নির্ভরশীল দুষ্কৃতীরা ভোটকর্মীদের উপর হামলা চালিয়েছেন। কোথাও ভোটকর্মীদের শঙ্কায় কাঁদতে দেখা গিয়েছে, কোথাও ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের শৌচালয়ে গোপনে প্রাণ বাঁচিয়েছেন তাঁরা। কেউ আবার ভোটকেন্দ্রের বাইরে বোমা পড়ার পর হেল্প চেয়ে ফোন করেছেন প্রশাসন অথবা পরিচিতদের কাছে।

শনিবার দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগরে বুথের মধ্যেই আক্রান্ত হন এক পোলিং অফিসার। তৃণমূল এবং নির্দল প্রার্থীর সমর্থকদের ভিতরে সংঘর্ষে জখম হন জয়নগরের রাজাপুর করাবেগ গ্রাম পঞ্চায়েতের পোলিং কর্মকর্তা অমর্ত্য সেন। তাঁকে ডাক্তারখানায় ভর্তি করানো হয়েছে। বীরভূমের ময়ূরেশ্বরের গোপীনাথপুরে বিজেপি, তৃণমূল এবং নির্দলের সংঘর্ষ। আতঙ্কে বুথ ছেড়ে পালিয়েছেন বুথকর্মীরা। বুথ ভাঙচুর করার নালিশ উঠেছে। প্রাণ বাঁচতে পালিয়েছেন প্রিসাইইডিং অফিসারও।

ভোটকর্মীদের আক্রান্ত হওয়ায় শাসকদলের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছে রাজ্য সরকারী সহযোগীদের সংস্থা সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ। আহ্বায়ক ভাস্কর ঘোষ বলেন, ‘‘আমরা জনতাম ভোটে সন্ত্রাস হবেই। তাই আগে থাকতে ভোটকর্মীদের জন্য হেল্পডেস্কের ব্যবস্থা করেছিলাম। প্রায় দেড় হাজার অভিযোগ পেয়েছি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অস্ত্র নিয়ে ভোটকর্মীদের ভয় দেখানো হয়েছে। কোথাও বোমাবাজি করে ভীতি দেখানো হয়েছে। এরূপ অভিযোগও আমরা পেয়েছি, যেখানে জানানো হয়েছে, শুক্রবার রাতেই বহু জায়গা লুঠপাট করে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দিয়েছে।’’ ভোটকর্মী মিলন মঞ্চ আবার একই সঙ্গে ৩টি সাপোর্টলাইন নম্বর শুরু করেছিল। তাদের নেতা স্বপন মণ্ডল বলেন, ‘‘ভোটকর্মীদের ভয় দেখানো, অসম্মান করা এই ধরনের নালিশ তো ছিলই। এ বার আরও এক ধরনের কমপ্লেইন শুনলাম যা আমরা প্রথমে কোনো সময়েই দেখিনি বা শুনিনি। শুক্রবার রাত থেকেই নাকি কোথাও কোথাও ইলেকশন প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছিল শাসকদলের গুন্ডাবাহিনী। তাঁরা সন্ধ্যা হতে সারা রাত ছাপ্পা করেছে। ফলে ভোটকর্মী ভয়ে সারা রাত ঘুমতে পারেননি। আর ভোরে ভোটের প্রস্তুতি রাখলেও কেউ ভোট দেওয়ার জন্য আসেননি।’’

Advertisement

তবে শাসকদল তৃণমূল এই কমপ্লেইন উড়িয়ে দিচ্ছে। দলের মুখপাত্র শান্তনু সেন বলেন, ‘‘আমি নিজে আরামবাগ শহরে বিজেপির হাতে তৃণমূল কর্মীদের আক্রান্ত থেকে দেখেছি। আমাদের ৯ জন কর্মীর পরিস্থিতি বেশ খারাপ। একজনের তো আবার অক্ষি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ওনাকে কলকাতা মেডিক্যাল মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়েছে। বিজেপি বিধায়ক বিশ্বনাথ কারক ও সুশান্ত ঘোষ পরিকল্পিত ভাবে এই সন্ত্রাস করেছেন। আমরাই যেখানে আক্রান্ত হচ্ছি, ওই জায়গা ভোটকর্মী সংগঠনের কমপ্লেইন মিথ্যা বলেই আমার মনে হয়।’’

আরও পড়ুন

Latest articles

Leave a Comment

%d bloggers like this: