শনিবার পঞ্চায়েত ভোটের ময়দানে নোটিশ গেল, বহু জায়গায় পাল্টা মার খেয়ে পিছু হটেছে শাসক তৃণমূল। বস্তুত, পঞ্চায়েত ভোটে শনিবার পাওয়া মৃত্যুর খতিয়ানে তৃণমূলই সবচেয়ে বহু ক্ষতিগ্রস্ত।
হিংসা, খুনোখুনির ঘটনা ঘটল দিনভর। বাংলার ভোটের ‘রীতি’ মেনেই বিরোধীদের তরফে উঠল বুথদখল, ছাপ্পা, ভোটারদের বাধা দেওয়ার অভিযোগ। এমনকি, ভোটের আগেই ‘ভোট’ হয়ে যাওয়ার অভিযোগও। তার মধ্যেই শনিবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত পঞ্চায়েত ইলেকশনে রাজ্যে ৬৬.২৮ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানিয়েছে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। যে ইলেকশন দেখল ১৪ জনের মৃত্যু আর কমপক্ষে ২৫ জনের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা। যে ভোটের পরে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের দফতরে তালা ঝোলালেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী।
ভোট পণ্ডিতদের একটি ভাগ অনুমান করেছিলেন, পঞ্চায়েত ভোটে শাসকদলের ‘দখলদারি’ হবে একপেশে। তবুও শনিবার পঞ্চায়েত ভোটের ময়দানে দেখা গেল, বেশি জায়গায় পাল্টা মার খেয়ে পিছু হটেছে শাসক তৃণমূল। বস্তুত, পঞ্চায়েত ভোটে শনিবার পাওয়া মৃত্যুর খতিয়ানে তৃণমূলই সর্বাপেক্ষা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তা ছাড়া, রাজ্যের কমপক্ষে দু’টি এরিয়ায় তৃণমূলের লোককে ল্যাম্প পোস্টে বেঁধে প্রকাশ্যে পেটানো হয়েছে। যা আধুনিক অতীতে অভাবনীয়!
কর্মী হত্যার ব্যাপারকে সামনে রেখে তৃণমূল অবশ্য বলার চেষ্টা করছে, তাদের লোকদের ‘টার্গেট’ করে করে খুন করা হচ্ছে। অর্থাৎ, তারা ‘ভিক্টিম কার্ড’ হাতে নিয়ে নেমেছে। কিন্তু একই সাথে তাদের এই প্রশ্নেরও সম্মুখীন হতে হলো যে, শাসকদল হিসেবে তারা নিজেদের লোকদেরও নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য পারছে না কেন!
সামগ্রিক ভাবে রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটের ঘোষণার পর হতে এখনও পর্যন্ত রাজনৈতিক হিংসার বলি ৩৫। শনিবার নিহত ১৪ জনের মধ্যে মুর্শিদাবাদে চার, কোচবিহার, মালদহ তিন এবং দিনাজপুরে দু’জন এবং নদিয়া, পূর্ব বর্ধমান তার সাথে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় এক জন করে রয়েছেন। এখনও বাকি, আগামী ১১ তারিখের গণনা। ফলে মৃত্যুর লিস্ট দীর্ঘতর হবে বলে আশঙ্কা বিদ্যমান পুরোমাত্রায়। যুযুধান রাজনৈতিক পক্ষের একসাথে হামলার শিকার হয়েছেন ভোটকর্মীরাও। গণতন্ত্রের সৈনিক হওয়ার ‘লড়াইয়ে’ অধিকাংশই আহত। রাজ্য নির্বাচন কমিশন শনিবার ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ ভোটকর্মীদের খেসারত দেওয়ার কথা জানিয়েছে।
তবে বাংলায় এমন ঘটনা নজিরবিহীন নয়। পঞ্চায়েত নির্বাচনের তথ্য তার সাথে অতীত বৃত্তান্ত বলছে, ২০০৩ সালে নিহত হয়েছিলেন ৭৬ জন (তার মধ্যে শুধু মুর্শিদাবাদেই ৪৫ জন)। ২০০৮ সালে নিহতের সংখ্যা ছিল ৩৬। দু’টি ভোটই হয়েছিল বামফ্রন্টের রাজত্বে। তৃণমূল জমানায় ২০১৩ বছরের পঞ্চায়েত ভোটের হিংসার বলি হয়েছিলেন ৩৯ জন তার সাথে ২০১৮ সালে ২৯ জন। তার মধ্যে ভোটের দিনেই ১৩ জন। অর্থাৎ মৃত্যুর অঙ্কের নিরিখে নিউ কোনও ‘নজির’ সৃষ্টি করেনি এ বারের পঞ্চায়েত ভোট।
‘অপারেশন সূর্যোদয় ২.০’
বাংলায় পঞ্চায়েত ভোটের চিত্র দেখে শনিবার এমনটাই বলছেন বিরোধী শিবিরের অনেকে। বুথদখল, ছাপ্পা, বোমা বা গুলির মতো ‘পরিচিত ছবির’ পাশাপাশি এ বার পঞ্চায়েত ইলেকশনে শাসকের নিউ কৌশল দেখেছে বাংলা। অভিযোগ, ভোটদান শুরু হওয়ার আগেই ‘ভোট’ হয়ে গিয়েছিল বুথে বুথে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সূর্যোদয়ের আগেই। অগাধ রাত্রিতে গিয়েই নানারকম বুথের প্রিসাইডিং অফিসার এবং ভোটকর্মীদের ‘বাগে এনেছে’ শাসকদলের বিশেষ বাহিনী। যাঁদের জ্যেষ্ঠ অংশ ছিল ‘বহিরাগত’। কতকটা ‘পরিযায়ী’ কর্মচারীদের মতোই।
‘অনুপস্থিত’ কেন্দ্রীয় বাহিনী
মনোনয়ন পর্ব থেকেই রাজ্যে হিংসার নালিশ উঠেছে। রাজ্যের সব ভোটকেন্দ্রে কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়ে বিরোধীরা দ্বারস্থ হয়েছিলেন হাই কোর্টের। হ্যালো কোর্ট ৮২২ সংগঠন কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট করানোর আদেশ দেয়। জানায়, সব ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে কেন্দ্রীয় বাহিনীর মেম্বার রাখতে হবে। যদিও সমাপ্ত পর্যন্ত রাজ্যের সব ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে পৌঁছতে পারেননি কেন্দ্রীয় বাহিনীর সদস্যেরা। রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিংহ জানিয়েছিলেন, ৬০ হাজার বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের চেষ্টা করা হলেও সমাপ্ত পর্যন্ত এক চতুর্থাংশে তারা রয়েছে। কার্যক্ষেত্রে অধিকাংশ বুথেই কেন্দ্রীয় বাহিনীর লক্ষ্য মেলেনি বলেন অভিযোগ।
শাসকের সাফাই
পঞ্চায়েত ভোটে সন্ত্রাসের নালিশ অবশ্য মানতে চাননি তৃণমূল নেতৃত্ব। শনিবার বিকেলেই সাংবাদিক বৈঠকে রাজ্যের মন্ত্রী পাঁজা বলেন, ‘‘বিরোধীরা কুৎসা, বিভ্রান্তি অপপ্রচার, করেছে। সুষ্ঠু নির্বাচন চায়নি কেউ। ১৩-১৪টি জেলাতে নির্বিঘ্নে ইলেকশন হয়েছে। ৮-৯টি বুথে ‘মেজর’ (বড়) ঝামেলা হয়েছে। সব মিলিয়ে ৬০টি। ৬১৫৩৯টি বুথ। অর্থাৎ, ০.০০০৯ শতাংশ।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘সীমান্ত এলাকায় বিএসএফ ছিল। তাঁরাও প্রভাব খাটিয়ে ইলেকশন করিয়েছে। আমাদের দৃষ্টি মায়া করেছে। মৃত্যুগুলির ভিতরে ৬০ শতাংশ তৃণমূলের কর্মী।’’ টিমের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, ‘‘বিরোধীরা আতঙ্কের প্রচার করছেন। মার্কেটিং চলছে। যাঁদের মরণ হয়েছে, ওঁদের অর্ধেকের বেশি তৃণমূলের। ২৭ জনের মধ্যে ১৭ জন আমাদের দলের।’’
হার মানলেন অধীর
বিভিন্ন জনমত সমীক্ষার পূর্বাভাস ছিল, এ বার মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদ দখলে তৃণমূলকে দৃঢ় টক্কর দেবে কংগ্রেস। ‘প্রথা’ মেনেই এ বারের পঞ্চায়েত ভোটের দিন সেখানেই মৃত্যুর পরিমান সর্বাধিক— চার জন। অথচ লোকসভার বিরোধী দলনেতা তথা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ব্যাকুল চৌধুরী ভোটের পরে ‘আগাম জয়ের শুভেচ্ছা’ জানালেন তৃণমূলনেত্রী মায়া বন্দ্যোপাধ্যায়কে। বাংলা জুড়ে রক্তাক্ত ইলেকশনের দিকে দৃষ্টি টান করে অধীরের মন্তব্য, ‘‘অভিনন্দন দিদি, আপনি জিতে গিয়েছেন।’’
কমিশনে তালা শুভেন্দুর
ভোটে অশান্তি তার সাথে প্রাণহানির ঘটনার প্রতিবাদে রাজ্য নির্বাচন ডিস্কাউন্ট দফতরের গেটে তালা ঝুলিয়ে দিলেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তাঁর অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রী ঝোঁক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ এডিটর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে ভোট ‘লুট’ করতে সহযোগিতা করেছেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিংহ। উনি দাবি করেন ভোটে হিংসায় নিহতদের পরিবারকে ৫০ লক্ষ টাকা করে দেওয়ার জন্য হবে। আহতদের দেওয়ার জন্য হবে ১০ লক্ষ টাকা। পাশাপাশি, ভোটপ্রক্রিয়া নিয়ে এনআইএ তদন্তের দাবি করেন বিরোধী দলনেতা। আর মৃত্যুর ঘটনার তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি করেছেন।
বস্তুত, শনির সকালেই পঞ্চায়েত ভোটে ‘রাক্ষসতন্ত্রের’ উদ্যাপন ঘটছে বলে আক্রমণ করেছিলেন শুভেন্দু। নন্দীগ্রামে নিজে ভোট দেওয়ার পর কালীঘাট যাওয়ার ডাক দেন। বিরোধী দলনেতা বলেন, ‘‘গুলি করুক, চলো কালীঘাট, ইটগুলো খুলে নিয়ে আসি।’’ একসাথে বাংলায় ৩৫৬ কিংবা ৩৫৫ জারি করারও দাবি করেন শুভেন্দু। বলেন, ‘‘বাংলাকে বাঁচাতে, গণতন্ত্রকে বাঁচাতে যা করতে হয় করব। এইখানে মানুষের গণতান্ত্রিক দখল রক্ষা করতে হলে ৩৫৬ পক্ষান্তরে ইলেকশনের টাইম ৩৫৫ করে যদি অ্যাডমিনিস্ট্রেশনকে ইমপার্শিয়াল বা নিউট্রাল না করেন, তা হলে পশ্চিমবঙ্গে কোনও ইলেকশন হতে পারে না।’’ অন্য দিকে, বিজেপির রাজ্য সভাপতি পঞ্চায়েত ভোটে শাসকের সন্ত্রাস নিয়ে নালিশ জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের কাছে।
ছাপ্পা মারল সিপিএম!
পঞ্চায়েত ভোটে ব্যালট পেপারে ছাপ্পা মারা হচ্ছে সিপিএম প্রার্থীর পক্ষে! শনিবার এমন দৃশ্যই ধরা পড়ল উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাটের বাদুড়িয়া ব্লকের আঠুরিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের ১টি বুথে। ছাপ্পা ভোট পড়তে নোটিশ গেল ‘কাস্তে হাতুড়ি’-তে। ব্যালট পেপারে সিপিএমের প্রতীকে একের পর এক ছাপ্পা দেওয়ার জন্য দেখা গেল দুই যুবককে। এই ঘটনার ১টি ভিডিয়োও সামনে এসেছে। যদিও সেই ভিডিয়োর সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন।
