হাই কোর্টের নির্দেশ ছিল সব ভোটকেন্দ্রে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন হবে। কিন্তু দিনভর ভোট চললেও সব বুথ তো মুছে অস্ত, বেশির ভাগ বুথেই লক্ষ্য মেলেনি কেন্দ্রীয় বাহিনীর, এমনই অভিযোগ বিরোধীদের।
স্থান— হাওড়ার ডোমজুড় ব্লকের মহিয়াড়ি-২ পঞ্চায়েত, তিন বুথের কিবরিয়া গাজি হ্যালো স্কুল
সকাল থেকেই ভোটদানের ভিড়। কিন্তু নোটিশ নেই কেন্দ্রীয় বাহিনীর এক জন জওয়ানের।
দৃশ্য দুই
স্থান— জবাব ২৪ পরগনার গোবরডাঙার বেড়গুম-১ পঞ্চায়েতের ঝনঝনিয়া এফপি স্কুলে ১৮০ ও ১৮১ নম্বর বুথ
দেখা নেই কেন্দ্রীয় বাহিনীর এক জন জওয়ানেরও। এখানেও ভোটদাতাদের ভিড় সকাল থেকেই।
দৃশ্য তিন
স্থান— নন্দীগ্রামের তারাচাঁদবাড় বুথ
দেখা নেই কেন্দ্রীয় বাহিনীর। প্রতিবাদে বুথে তালা স্থানীয়দের।
খণ্ডচিত্রে স্পষ্ট কেন্দ্রীয় বাহিনীর দেখা পাননি এই বুথগুলির ভোটদাতারা। তা সত্ত্বেও কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশ ছিল সব ভোটকেন্দ্রে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের। কেবল এই তিনটি জায়গাই নয়, বাঁকুড়া হতে পূর্ব বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে কোচবিহার— কেন্দ্রীয় বাহিনীর লক্ষ্য পাওয়া যায়নি প্রায় সারা দিনই। তা হলে শনিবার পর্যন্ত যে ৬৫০ সংস্থা কেন্দ্রীয় বাহিনী রাজ্যে এল, তাঁরা কোথায় গেলেন! কমিশন জানিয়েছিল, ৪,৮৩৪টি স্পর্শকাতর বুথ-সহ কমবেশি ১৫ হাজার ভোটকেন্দ্রে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের পরিকল্পনা ছিল তাদের।
শুক্রবার রাতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর কোঅর্ডিনেটর বিএসএফের আইজি এসসি বুদাকোটি লিখিত ভাবেই রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, প্রতি ভোটকেন্দ্রেই চার জন করে জওয়ান (হাফ সেকশন) মোতায়েনের পক্ষপাতী তাঁরা। সেই নিরিখে রাজ্যের মোট ৪৪,৩৮২টি ভোটকেন্দ্রের জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনীর মুল্যবান সদস্য প্রয়োজন নিদেনপক্ষে এক লক্ষ ৭৮ হাজার। প্রতি ভোটকেন্দ্রে দু’জন করে মেম্বার রাখার জন্য গেলেও চাই ৮৮ হাজারের বেশি। এই পরিস্থিতিতে আদালতের আদেশ মেনে কী ভাবে প্রতি ভোটকেন্দ্রে বাহিনী মোতায়েন হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বিরোধীরা।
সাধারণ নিয়ম বলে, ১টি বা দু’টি বুথের ভোটকেন্দ্রে ‘হাফ সেকশন’ মোতায়েন করা হয়ে থাকে। কার্যকরী এক সেকশন (আট জন) থাকে তিন তার সাথে চার বুথের ভোটকেন্দ্রে। পাঁচ, ছয় বুথের ভোটকেন্দ্রে দেড় সেকশন (১২ জন) তার সাথে সাত বা তার বহু ভোটকেন্দ্রে দুই সেকশন (১৬ জন)। তবুও কার্যক্ষেত্রে লক্ষ্য গেল বেশির ভাগ বুথেই চিহ্ন নেই কেন্দ্রীয় বাহিনীর। একটি ছোট্ট নমুনা দিলে বিষয়টি এইরকম স্পষ্ট হবে। ভোট শুরুর ঘণ্টা দুয়েক পরবর্তী মেজারমেন্ট বলছে, বাঁকুড়ার ৩,১০০টি বুথের মধ্যে মাত্র ৭৫৭টি বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনীর নোটিশ মিলেছে। অর্থাৎ ২,৩৪৩টি বুথ ছিল কেন্দ্রীয় বাহিনীহীন।
এখন প্রশ্ন হল, এমনটা হল কেন? নিজের মতো করে তার উত্তর দিয়েছেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিংহ। উনি বলেন, ‘‘নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল কেন্দ্রীয় বাহিনী। শনিবার পর্যন্ত ৬৫০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী রাজ্যে এসে পৌঁছতে পেরেছে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর আসতে এত বিলম্ব হল কেন? আমরা তো বাহিনী চেয়ে চিঠি দিয়েছিলাম ২২ জুন। তার পর মনেও করিয়েছিলাম বেশ কতিপয় বার। তা সত্ত্বেও ৪৮৫ কোম্পানী বাহিনী দিতে জুলাই মাসের ৩ তারিখ হয়ে গেল! আমার মনে হয় আরও কিছু প্রথমে বাহিনী এলে অ্যাডভান্টেজ হত।’’
অবশ্য রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের এই ভাষণের অল্পসংখ্যক ঘণ্টার মধ্যেই তার উত্তর আসে দিল্লি থেকে। তাতে পাল্টা দায় চাপানো হয় কমিশনের উপরেই। ভোট শেষ হওয়ার পরে জারি করা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের পাল্টা ভাষণে দাবি করা হল, কেন্দ্রীয় বাহিনী আসতে লেট হয়েছে, রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সহযোগিতা না পাওয়ার কারণেই। উক্তিতে তা বিশদে বর্ণনাও করে অমিত শাহের মন্ত্রক। ভাষণে জানানো হয়, কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের জন্য দেরিতে অনুরোধ করেছে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। সাধারণত বাহিনীর জন্য ট্রেনের বন্দোবস্ত তার সাথে আদার্স আয়োজন করতে সময় লাগে। রাতারাতি তা করা যায় না। এ ছাড়া, কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করার জন্য তাদের কোথায় ট্রেন হতে নামতে হবে বা কোথায় পৌঁছতে হবে সেই সম্পর্কে বিশদ তথ্য চাই হয়।
কিন্তু শনিবার পর্যন্ত সেই ইনফরমেশন রাজ্য নির্বাচন কমিশন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে জানায়নি। উক্তিতে দাবি করা হয়েছে, তার বদলে বাহিনীর কো অর্ডিনেটরদের বলে দেওয়া হয় এ ব্যপারে জানতে হলে জেলাশাসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য হবে। যা করতে এক্সট্রা টাইম লেগেছে। উদাহরণ দিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক জানিয়েছে, উত্তরবঙ্গে যে বাহিনী মোতায়েন করার কথা ছিল, তাদের উত্তর-পূর্ব ভারত হতে আনানো যেত। তাতে তারা ইজিলি এবং কম সময়ে উত্তরবঙ্গে পৌঁছতে পারত। কিন্তু যে মূল কোথায় যেতে হবে, তা অপরিচিত ছিল, একারণে শুরুতে বাহিনীকে উত্তরপূর্ব ইন্ডিয়া থেকে কলকাতায় আনা হয়। তার পর কোথায় মোতায়েন করা হবে তা জেনে পাঠানো হয় উত্তরবঙ্গে।
যার ফলে শুধু যাতায়াতেই অতিরিক্ত দু’দিন টাইম লেগে গিয়েছে। এর পাশাপাশি, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের যুক্তি, কিছু বাহিনীর শনিবার সন্ধ্যাতেও পৌঁছনোর কথা বাংলায়। নোডাল কর্মকর্তা কমিশনকে বলেছিলেন, এই বাহিনীকে স্ট্রংরুম পাহারার জন্য ব্যবহার করা হোক। তা সত্ত্বেও তাতে রাজি হয়নি কমিশন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের বক্তব্য, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কিছু বাহিনীকে স্ট্রং রুমের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োগ করতে রাজি হয়নি কমিশন। শাহের মন্ত্রকের দাবি, যে সমস্ত বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী ছিল, ওখান অশান্তি হয়নি। বরং কোনও বুথ দখলের ঘটনা দেখলেই শক্ত হাতে তা নিবারণ করতেও সাকসেস হয়েছে বাহিনী।
যে কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে শুরু থেকে এত টানাপড়েন, খাতায়কলমে বাহিনী এলেও কার্যক্ষেত্রে তার দেখাই পেলেন না গণতান্ত্রিক কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতে যাওয়া গ্রামীণ বঙ্গের লক্ষ লক্ষ ভোটাদাতা। কেন বাহিনী নেই, কোথায় গেল বাহিনী, তা নিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশন এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের মধ্যে চাপানউতর তুঙ্গে। কিন্তু প্রশ্ন হল বাহিনী নিয়ে দায় ঠেলাঠেলির সম্পন্ন কোথায়?
