বিরোধীরা সেই সব জায়গাতেই পাল্টা মারতে পেরেছে, যেখানে তারা ‘শক্তিশালী’। প্রত্যেকটি জায়গাতেই তারা ‘গণপ্রতিরোধ’-এর তত্ত্ব দিয়েছে। বক্তব্য, তৃণমূল বুথ লুট করার জন্য আসায় পাল্টা মার খেয়েছে।
পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন পর্ব শুরুর দিন সিপিএমের রাজ্য এডিটর মহম্মদ সেলিম তাঁর ফেবু পেজে একটি পোস্ট করেছিলেন। তাতে দেখা গিয়েছিল, খেঁটে লাঠির মাথায় আঁটা লালঝান্ডা। ছবির ক্যাপশনে সেলিম লিখেছিলেন— ‘প্রস্তুতি।’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী খোলাখুলিই বলেছিলেন, ‘‘বাধা দিলে বাধবে লড়াই!’’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার দলীয় মিটিংয়ে বলেছিলেন, ‘‘তৃণমূলের কেউ মারতে এলে তারা যেন তাদের পিঠে লাঠির ছাপ নিয়ে ফিরে যায়!’’
শনিবারের পঞ্চায়েত ভোটে সেই ছবিই নোটিশ গেল ফলিত স্তরে। মনে করা হয়েছিল, শাসকদলের ‘মাতব্বরি’ হবে একপেশে। তা সত্ত্বেও পঞ্চায়েত ভোটের ময়দানে লক্ষ্য গেল, বেশি জায়গায় পাল্টা মার খেয়ে পিছু হটেছে শাসক তৃণমূল। বস্তুত, পঞ্চায়েত ভোটে শনিবার বিকেল পর্যন্ত মৃত্যুর খতিয়ানে তৃণমূলই সর্বাপেক্ষা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। দুপুরের মধ্যে শাসকদলের মোট আট জন প্রাণ হারিয়েছেন। রাজ্যের কমপক্ষে দু’টি এরিয়ায় তৃণমূলের লোককে ল্যাম্প পোস্টে বেঁধে সামনে পেটানো হয়েছে। যা সাম্প্রতিক অতীতে অভাবনীয়! তাদের সহযোগী খুনের ব্যাপারকে সম্মুখে রেখে তৃণমূল অবশ্য বলার ট্রাই করছে, তাদের লোকদের ‘টার্গেট’ করে করে খুন করা হচ্ছে। অর্থাৎ, তারা ‘ভিক্টিম কার্ড’ হাতে নিয়ে নেমেছে। কিন্তু একই সঙ্গে তাদের এই প্রশ্নেরও সম্মুখীন থেকে হচ্ছে যে, শাসকদল হিসেবে তারা নিজেদের লোকদেরও নিরাপত্তা দিতে পারছে না কেন!
তার চেয়েও বড় ‘রাজনৈতিক’ প্রশ্ন— বিরোধীরা যে ‘পাল্টা মারের রাস্তা নিয়েছে, আগামী বছর লোকসভা ভোটে কি তার কোনও ইফেক্ট পড়বে? তবে পাশাপাশি এটিও আসলেই যে, বিরোধীরা সেই সব জায়গাতেই পাল্টা মার মারতে পেরেছে, যেখানে তারা সাংগঠনিক দিক দিয়ে ‘শক্তিশালী’। প্রতিটি জায়গাতেই অবশ্য বিরোধীরা ‘গণপ্রতিরোধ’-এর থিয়োরি দিয়েছে। তাদের বক্তব্য, তৃণমূল বুথ লুট করার জন্য এসেছিল। তখন তারা পাল্টা মার খেয়েছে।
পাশাপাশিই বহু জায়গায় দেখা গিয়েছে, দলমতনির্বিশেষে শাসকদলের বিরুদ্ধে তেড়ে গিয়েছেন। মোটরবাইক কেড়ে নিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছেন। লাথি মেরে ব্যালট বাক্স নর্দমায় বা দিঘিতে ফেলছেন। রোষের রিজন একটাই— তাঁদের ইলেকশন দেওয়ার জন্য দেওয়া হয়নি! সেই জনতায় সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি ভেদাভেদ করা যায়নি। সবাই মিলেমিশে সমান আকৃতিবিশিষ্ট হয়ে সেই ‘প্রতিরোধ’-এ শামিল হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাস বলে, শাসকদলের লোকেরা যখন বিরোধীদের হাতে মার খায়, তখন বুঝতে হয়, রাজ্যের রাজনীতি একটি তাৎপর্যপূর্ণ মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। অধিকাংশই পিছনে তাকিয়ে ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের কথা বলছেন। যে ভোটে পূর্ব মেদিনীপুর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পরিষদ জিতেছিল তৃণমূল। সেই থেকেই তাদের শুরু। সেই পঞ্চায়েত ভোটের পরবর্তী বছর লোকসভা ভোটে ধস নেমেছিল বামেদের। তার পর পর্যায়ক্রমে ২০১১ সালের ‘পরিবর্তন’। তবুও ২০০৮ বছরের পঞ্চায়েত ভোটেই প্রথম বোঝা গিয়েছিল, সিপিএম ‘অপরাজেয়’ নয়। বা সিপিএমকেও পাল্টা মার দেওয়া যায়।
তবে ১৫ বছর আগের পরিস্থিতি দিয়ে এখনকার সিচুয়েশন বিচার করা যাবে কি না, সে প্রশ্নও রয়েছে। কারণ, ১৫ বছর আগে বিরোধীদের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য টান বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন। যিনি তাঁর ব্যক্তিগত আন্দোলনের সাথে গণ আন্দোলনকে জুড়ে একটা সার্বিক সিপিএম-বিরোধী রূপ দিতে পেরেছিলেন। দ্বিতীয়ত, টান সেই টাইম কংগ্রেসকেও সাইডে পেয়েছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত সিপিএম-বিরোধিতার বিষয়টি যেমন প্রশ্নাতীত ছিল, তেমনই ছিল কংগ্রেসের মতো একটি সর্বভারতীয় টিমের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সহায়তাও। ফলে বামবিরোধী ভোট এককাট্টা করা গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও মমতার বিরোধিতা যারা করছে, সেই কংগ্রেস-সিপিএম-বিজেপি দলীয় ধারা তার সাথে বাধ্যবাধকতার কারণে কখনওই লোকসভা বা বিধানসভার ভোটে একাট্টা থেকে পারবে না। অথচ শনিবারের ভোটচিত্র বলছে, অদূরবর্তী ফিউচারে বিরোধীরা তাদের শক্তিবৃদ্ধি করতে পারে। লোকসভা ভোটে যা তৃণমূলের পক্ষে অশনি সঙ্কেত হয়ে লক্ষ্য দিতে পারে। বাম-কংগ্রেস থেকে যে ইলেকশন চলে গিয়েছিল, তা এর পরে ফিরে আসবে নাকি সেটাই দেখার।
শনিবার যে জেলাগুলিতে মার খেয়েছে তৃণমূল, তার মধ্যে আছে মুর্শিদাবাদ তার সাথে মালদহ। যে দু’টি জেলা ঐতিহ্যগত ভাবেই কংগ্রেসের ‘শক্ত ঘাঁটি’ বলে পরিচিত। নদিয়ায় ইদানীং বিজেপির বৃদ্ধিশীল হলেও একটা সময়ে সেখানেও কংগ্রেসেরই রমরমা ছিল। যেমন গ্রামীণ বর্ধমানে দাপট ছিল সিপিএমের। অনুব্রত মণ্ডলের অনুপস্থিতিতে দক্ষিণবঙ্গের বীরভূম তার সাথে হুগলিতে যেমন বিজেপি ভোটের ময়দানে শাসককে রুখে দেওয়ার ট্রাই করেছে। তেমনই উত্তরবঙ্গের কোচবিহারে বিজেপি ‘মারমুখী’ হয়েছে।
পঞ্চায়েত ভোটের দুপুর পর্যন্ত তৃণমূলের যে আট জন নিহত হয়েছেন, হত্যায় মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, জবাব দিনাজপুরে অভিযুক্ত কংগ্রেস। আবার পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়ায় তৃণমূল সহযোগীকে হত্যার নালিশ উঠে গিয়েছে সিপিএমের বিরুদ্ধে। মুর্শিদাবাদের খুন হন দুই তৃণমূল কর্মী। নদিয়ার চাপড়ায় দলবল নিয়ে ইলেকশন দেওয়ার জন্য যাওয়ার সময়ে কুপিয়ে খুন করা হয় এক তৃণমূল কর্মীকে।
ভোটের দিন শাসকদলের এত কর্মী খুন হওয়ার প্রসঙ্গে তৃণমূলের অন্যতম মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, ‘‘বিরোধীরা যে হিংসার নালিশ তুলছে, তা আসলে নাটক! সবচেয়ে অধিক ক্ষতি হলো তৃণমূলের। আমাদের কর্মীদেরই খুন করা হচ্ছে। আমরা সরকারে আছি। এজন্য দায়িত্বশীল দল সংখ্যায় সব জায়গায় বলছি, প্ররোচনায় পা দেবেন না।’’
যা শুনে অনেকেরই অতীতের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। বাম জমানার সম্পন্ন পর্বে যখন জঙ্গলমহলে একের পর এক সিপিএম সহযোগী খুন হচ্ছিলেন, সেই সময় বাম নেতারা তৃণমূল-মাওবাদী আঁতাতের থিয়োরির কথা বলতেন। বামফ্রন্টের অতীতের চেয়ারম্যান বিমান বসু দলীয় কর্মীদের উদ্দেশে বলতেন, ‘‘প্ররোচনায় পা দেবেন না। দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করুন।’’ তখনও প্রশ্ন উঠত, রাজ্যের প্রশাসনিক শ্রেষ্ঠ হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কেন নিজের দলের লোকেদেরই সিকিউরিটি দিতে পারছেন না?
বাংলায় পঞ্চায়েত ভোটে হিংসা-খুনোখুনির অতীত বৃত্তান্ত দীর্ঘ। ২০০৩ বছরের পঞ্চায়েত ভোট সেই নিরিখে কার্যত ‘মাইলফলক’ হয়ে আছে। সে বার ভোটের দিনই ৩০ জনের বহু মানুষের প্রাণ গিয়েছিল। শুধুমাত্র মুর্শিদাবাদের ডোমকলেই প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রায় ১৫ জন। তৃণমূল ক্ষমতায় প্রবল বৃষ্টিপাত পরেও ভোটে হিংসার ‘ঐতিহ্য’ বজায় থেকেছে। কোথাও কোথাও শাসকদলের ‘সন্ত্রাস’ বল্গাহীনও হয়েছে বলে দাবি বিরোধীদের। তবুও গত দু’টি পঞ্চায়েত ইলেকশনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লক্ষ্য গিয়েছিল, বিরোধী পক্ষের লোকেরা প্রাণ হারিয়েছেন। এ বার সেই ছবি খানিকটা উল্টে গেল! আরও ‘তাৎপর্যপূর্ণ’, কোথাও কুপিয়ে আবার কোথাও পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে তৃণমূল কর্মীদের। যার অর্থ, ঘিরে ধরে মারা হয়েছে। যে সূত্রে এই প্রশ্নও উঠছে যে, মারমুখী বিরোধীদের চক্রব্যূহ থেকে বার করে নিয়ে যাওয়ার লোকও কি শাসকদলের ছিল না? না কি বিরোধীদের ‘জোটবদ্ধ প্রতিরোধ’-এর সামনে শাসকদলের কর্মীরা এঁটে ওঠেননি!
তেমন সত্যিই হয়ে থাকলে তা তৃণমূলের পক্ষে অত্যন্ত ‘স্বস্তি’র মেসেজ বহন করে না। আবার পাশাপাশিই, এই এক্সপেরিয়েন্স শাসকদলের নিকট ‘বিপদসঙ্কেত’ হয়েও বাজতে পারে। আগামী এক বছরে আবাস গুছিয়ে নেওয়ার জন্য।
